স্মৃতিতে কোকো ট্রাজেডির ১১ বছর

DipKantha
DipKantha
প্রকাশিত: ১:৩০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৭, ২০২০

ইউনুছ শরীফ ===

 

২০০৩ সালের ৮ জুলাই নাসরিন ট্রাজেডির  সেই স্বজন হারানো দুঃখ-বেদনা আর আর্তনাদের কথা না ভুলতেই ফের একই রুট ঘটলো আরেক ট্রাজেডি।  ২০০৯ সলের ২৭ নভেম্বর রাতে এমভি কোকো-৪ লালমোহনের নাজিরপুর ঘাটে তেঁতুলিয়া নদীতে ২ সহস্রধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গিয়ে ঈদের আনন্দ-উৎসব মাটি করে দিল ভোলার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মেনে নিতে পারলেও শীত মৌসুমে শান্ত নদীতে এমন অনাকাংতি দুর্ঘটনা মেনে নিতে পারছে না। তেঁতুলিয়া নদী পাড়ের হাজার হাজার মানুষের স্বজন হারানো আর্তনাদে নাজিরপুরের আকাশ এখনো ভারি হয়ে আছে। রাজধানী ঢাকা থেকে ঈদে বাড়ি ফেরা এ মানুষগুলোর মনে কতো স্বপ্ননই না উকি দিচ্ছিল। প্রিয়জনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে কেউবা মায়ের জন্য নিয়ে এসেছেন শাড়ি, বোনের জন্য থ্রিপিচ, ভাইয়ের জন্য পাঞ্জাবি কিংবা আরো কতো কি! কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ পায়নি। ঈদের দিনে স্বজনের লাশ কাধে নিয়ে বাড়ি ফেরার চেয়ে ট্রাজেডি আর কি হতে পারে? ১১ বছর কাটলেও থামেনী এখনো স্বজনের কান্না।

ঘটনাস্থলে টানা সাত দিন অবস্থান করে- দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চ থেকে উদ্ধার পাওয়া যাত্রী, স্থানীয় উদ্ধারকারী দল ও প্রশাসন থেকে জানা যায় দুর্ঘটনার নানা বর্ণনা।

ঘটনার ৩৭ ঘণ্টা পর ২৯ নভেম্বর রোরবার  বেলা ১১ টায় বিআইডব্লিউটিএ-র উদ্ধারকারী জাহাজ ‘হামজা’ বরিশাল থেকে ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজ শুরু করলেও ব্যর্থ হয়। এতে এলাকাবাসী চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তারা জুতা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে উদ্ধারকারী জাহাজ লক্ষ্য করে। বিক্ষুব্ধরা ডুবে যাওয়া লঞ্চটির ওপরের অংশে ভাংচুর চালায়। স্বজন ও স্থানীয়রা উদ্ধার কাজে প্রশাসনের গড়িমসির অভিযোগও করেছে।

ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে ফিরে আসা কয়েকজন যাত্রী জানায়, ঈদের আগের দিন শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে ঢাকা সদরঘাট থেকে এমভি কোকো-৪ লঞ্চটি লালমোহনের উদ্দেশে ছাড়ে। ঈদে বাড়ি ফেরার তাড়ায় লঞ্চের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ওঠে। প্রায় ২-৩ হাজার যাত্রী নিয়ে টলমল করতে করতে লঞ্চটি গন্তব্যের দিকে আসতে থাকে। মাঝপথে এলে লঞ্চের পেছনে টয়লেটের তলা দিয়ে  ঢেউয়ের পানি উঠতে থাকে। এ সময় পাম্প দিয়ে পানি সেচ করে লঞ্চ চলাচল অব্যাহত থাকে। এভাবে চরম ঝুঁকি নিয়ে লালমোহনের কাছাকাছি আসতে থাকে লঞ্চটি। একাধিক যাত্রী জানায়, লালমোহন ঘাটের ১০ কিলোমিটার আগে দেউলা ঘাটে লঞ্চটি ভিড়লে অবস্থা বেগতিক দেখে যাত্রীদের অনেকে ভয়ে নেমে যেতে চায়। এ সময় লঞ্চ স্টাফরা কয়েক যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। এভাবে ডুবুডুবু অবস্থায় আরও ৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নাজিরপুর ঘাটে ভিড়ে। তখন যাত্রীরা দ্রুত নামার জন্য তাড়াহুড়া করলেও লঞ্চ স্টাফরা টিকিট কাটার জন্য যাত্রীদের নামতে বাধা দেয়, যাত্রীরা হৈচৈ করতে থাকলে লঞ্চটি আরও বেশি টলতে থাকে। একপর্যায়ে লঞ্চটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে ঘাট থেকে প্রায় ৫০ গজ পেছনে এনে পাড়ের সঙ্গে ঠেকানো হয়। এরপর যাত্রীরা দ্রুত নামার জন্য লঞ্চের একপাশে বেশি যাত্রী এলে লঞ্চটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কাত হয়ে পড়ে। এ সময় লঞ্চের পেছনের অংশসহ বেশির ভাগ ডুবে যায়। যাত্রীরা প্রাণ বাঁচাতে লাফিয়ে নদীতে পড়তে গিয়ে অনেকে আহত হয়। বেশির ভাগ যাত্রীই সাঁতরিয়ে পাড়ে ওঠে।

লঞ্চডুবির সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে রাত থেকে নাজিরপুর-তেঁতুলিয়ার পাড়ে হাজার হাজার স্বজন ও এলাকাবাসী ছুটে আসেন। স্থানীয়রা জানায়, তারা তাৎক্ষণিক নৌকা নিয়ে ও নদীতে নেমে উদ্ধার কাজে নেমে পড়ে। বুয়েট শিক্ষার্থী ও সভাপতি, লালমোহন নাজিরপুর স্টুডেন্ট ফোরাম, হালিম সালেহীর নেতৃত্বে  সংগঠনের প্রায় ৭০ জন সদস্য উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। এ সময় বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর কাজে সহযোগিতা করে কোস্ট ট্রাস্টের এরিয়া ম্যানেজার ফজলুল হকওে নেতৃত্বে একটি দল।

২৭ নভেম্বর রাত থেকে ২৮ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত ১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঈদের আমেজ, আনন্দ উৎসব ভুলে পরদিন সকালে হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হতে থাকে নাজিরপুর-তেঁতুলিয়ার পাড়ে। নাজিরপুরলঞ্চ ঘাটটি বোরহানউদ্দিন-লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলার মাঝামাঝি হওয়ায় অধিকাংশ যাত্রী এ ৩ উপজেলার। এসব উপজেলার গ্রামের নারী-পুরুষ, স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ছুটে আসতে থাকে। বসে থাকেননি রাজনৈতিক নেতারা। জেলা শহর থেকে মোটরসাইকেল ও মাইক্রোযোগে এরাও ছুটে এসে উদ্ধার অভিযানে নামে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, ঈদের দিন সকাল থেকে তাদের লাশ উদ্ধার কাজ করতে দেয়নি প্রশাসন। দুপুরে বরিশাল নৌ ফায়ার সার্ভিসের ৩ সদস্যের একটি ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছলে তারা লাশ উদ্ধারে নামে। এরা হচ্ছে সবির সরদার, মোঃ নুরু ও মোসলে উদ্দিন সরকার। এরপরই বের করে আনতে থাকে একের পর এক লাশ। স্থানীয় এমপি মেজর জসিমের নেতৃত্বে স্থানীয় ২০ জনের একটি দলও লাশ উদ্ধারে কাজ করতে থাকে। বিকালে আরও একটি ডুবুরি দল এসে কাজ শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই দিন ৩৫টি লাশ উদ্ধারের পর অভিযান বন্ধ রাখা হয়। তবে স্থানীয়রা স্বজনদের খোঁজে রাতভর অভিযান অব্যাহত রাখে।

পরদিন ২৯ নভেম্বর রোববার সকাল থেকে ডুবুরি দল ফের অভিযান শুরু করে। বেলা ১১টায় উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ঘাটে এসে পৌঁছে ১২টায় কাজ শুরু করে। বেলা ২টায় ডুবে যাওয়া লঞ্চটিকে টেনে সোজা করা সম্ভব হয়। এ সময় তৃতীয় তলা ওপরে তুলে আনে। নিচতলা ও দ্বিতীয় তলা উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। তৃতীয় তলার কেবিন ও আশপাশ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫৫টি লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। হামজা কর্তৃপক্ষের উদ্ধার কাজে ঢিলেমির অভিযোগে স্থানীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। সন্ধ্যায় উদ্ধার কাজ বন্ধ ঘোষণার কথা শুনে রাত ৭টার দিকে স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ উদ্ধার করা লঞ্চের ওপরের অংশ ভাংচুর করতে থাকে। এ সময় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ আইন-শৃংখলা বাহিনী অসহায় হয়ে পড়ে। এরা অবস্থান নেয় উদ্ধারকারী জাহাজ হামজায়। এ সময় উত্তেজিত জনতাকে মাইকে শান্ত থাকা ও উদ্ধার অভিযান চালানো হবে বলে ঘোষণা দিতে থাকে লালমোহন উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম ও ভোলা-৩ আসনের সাংসদ। রাতে উত্তেজনা কমে এলে ফের স্থানীয়রা লঞ্চটি ঘিরে রেখে নিজেরা উদ্ধার অভিযান চালায়। এ সময় পাওয়া যায় আরও ৪টি লাশ। সোমবার সকাল থেকে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সকালে কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা নূরনবী চৌধুরী শাওন তার দলবল নিয়ে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মোট ৮৭ জনের লাশ উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে কত লাশ ভেসে গেছে তা নিশ্চিত করতে পারেননি কেউ।

তোপের মুখে উদ্ধারকারী জাহাজ :

উদ্ধার কাজে বিলম্ব হওয়ায় উত্তেজিত জনতার তোপের মুখে পড়ে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজাসহ প্রশাসনের লোকজন। দুর্ঘটনার ৩৭ ঘণ্টা পর হামজা নাজিরপুর এসে উদ্ধার কাজ শুরু করলেও জীবিত কাউকে উদ্ধার করতে পারেনি। রোববার বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর বেলা সোয়া ১টায় লঞ্চটি টেনে সোজা করে। পুরোপুরি টেনে তুলতে না পারায় জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে হামজা কর্তৃপক্ষ ব্যর্থতা প্রকাশ করায় জনগণ জুতা, ইট ও কাদা ছুড়তে থাকে উদ্ধারকারীদের লক্ষ্য করে। স্থানীয়দের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয় দিনের মধ্যে লঞ্চ না উঠালে রাতে লাশ উঠিয়ে পেট কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। পরে এমপি মেজর জসিম, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সিদ্ধান্ত নিয়ে উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করেন। এ সময় পুলিশ সদস্য লিটন চন্দ হাওলাদারসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। বিআইডবি¬উটিএ’র চেয়ারম্যান আঃ মালেক মিয়া জানান, হামজার ধারণ ক্ষমতা ৬০ টন কিন্তু ডুবে যাওয়া কোকো-৪ লঞ্চের ওজন প্রায় ৫০০ টন। এ কারণে পুরোপুরি লঞ্চটিকে উত্তোলন সম্ভব নয়। তেঁতুলিয়া নদীর গভীরতা কম হওয়ায় শনিবার সকালে রওনা দিয়ে রোববার সকালে এসে পৌঁছায়। তিনি আরও জানান, ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি  গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত শুরু করেছে।

 

তদন্ত কমিটির তৎপরতা

তেঁতুলিয়া নদীতে এমভি কোকো-৪ লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত টিম ১ ডিসেম্বর স্থানীয় তদন্ত শেষ করে ঢাকায় চলে যায়। প্রাথমিকভাবে তদন্ত টিমের ধারণা, অতিরিক্ত যাত্রী বহনই এ দুর্ঘটনার কারণ। কোকো সম্পূর্ণ উদ্ধার না হলেও তদন্ত শেষ করায় এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা গেছে। এই টিম লঞ্চযাত্রী ও ঘাটের প্রত্যক্ষদর্শীসহ ৩০ জনের বক্তব্য রেকর্ড করার পাশাপাশি লঞ্চের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা মেপেছেন। ঢাকায় বসে তদন্ত রিপোর্ট দেবেন। এলাকার হাজার হাজার মানুষের প্রশ্ন বিগত ৩৮ বছরের তদন্তের মতো এ তদন্ত কোন উপকারে আসবে না। এ তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়েও তাদের সংশয় রয়েছে।

লঞ্চডুবি ও উদ্ধার তৎপরতায় অবহেলার অভিযোগে বিআইডবি¬উটিএ’র ৩ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কামাল উদ্দিন দুর্ঘটনার জন্য নির্দিষ্ট ৯ জনসহ মোট ২৫ জনকে আসামি করে লালমোহন থানায় হত্যা মামলা করেছেন । বিএনপি নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে এ মামলাটিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন।

লালমোহন থানায় দায়ের করা এ মামলা সম্পর্কে (মামলা নং-১৭)। তদন্ত কর্মকর্তা জানান- লঞ্চের ৯ জন স্টাফকে শনাক্ত করে অজ্ঞাত ১৬ জনসহ ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে । তবে এই মামলায় লঞ্চ মালিকপক্ষের কাউকে প্রাথমিকভাবে আসামি করা হয়নি। পুলিশ মামলার তদন্তের স্বার্থে আসামিদের নামসহ মামলার বিস্তারিত তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে জাকির হোসেন ফকির, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, লালমোহন থানা। তবে বাদী ও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, উলি¬খিত ৯ আসামির মধ্যে লঞ্চের চালক, মাস্টার, সুপারভাইজার ও টিকিট মাস্টার রয়েছে। পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে এক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

 

 

ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল হামজা-রুস্তম

নীচতলার অধিকাংশ পানির নীচে রেখেই উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ২ ডিসেম্বর বুধবার রাত সোয়া ৮টার দিকে স্থানীয় প্রশাসন, বিআইডবি¬উটিএ, ফায়ার ব্রিগেড, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে উদ্ধার অভিযান শেষ করেন। উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার ফলে নিমজ্জিত কোকো-৪ উদ্ধার হওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে কোকো-৪ লঞ্চের ভাগ্যে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এদিকে উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে গিয়ে তোপের মুখে পড়ে জেলা প্রশাসন ও উদ্ধারকারী কর্মকর্তারা। পরদিন ৩ ডিসেম্বর  সকালে ডুবুরি নামানো হবে বলে বিক্ষুব্ধ জনতাকে আশ্বস্ত করেছে জেলা প্রশাসক। লালমোহনের উপজেলা নির্বাহী অফিসার বাবর আলী মীর জানান, রুস্তম ও হামজার ক্যাপাসিটি কম থাকায় আর উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব নয়। এজন্য উদ্ধার অভিযান শেষ করা হয়েছে। ভোলার জেলা প্রশাসক মোঃ মেসবাহুল ইসলাম জানান, মূল অভিযান শেষ।

অপরদিকে স্থানীয় স্টুডেন্ট ফোরাম ও ছাত্র কল্যাণ সমিতি ত্রুটিপূর্ণ নৌযান প্রত্যাহার ও নিরাপদ নৌরুটের জন্য ১৩ দফা দাবিসহ স্মারকলিপি দিয়েছে। একই সঙ্গে এসব সংগঠন লালমোহনে মানববন্ধন করেছে। এসময় লঞ্চডুবির জন্য অভিযুক্তদের বিচারও দাবি করা হয়।

তোপের মুখে প্রশাসন : তেঁতুলিয়ায় ডুবে যাওয়া এমভি কোকো-৪ সম্পূর্ণ না তুলে এবং নিখোঁজ যাত্রীদের লাশ না উদ্ধার করেই রুস্তম ও হামজার উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েছেন ভোলার জেলা প্রশাসন ও উদ্ধারকারী কর্মকর্তারা। বুধবার রাত ৮টায় এমন সিদ্ধান্তে প্রশাসনের গোপন বৈঠকের কথা শুনেই স্থানীয়রা চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। নিখোঁজদের স্বজনরা ছুটে এসে তাদের নিখোঁজ স্বজনদের উদ্ধার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। ইউএনও বাবর আলী মীর জানান, রুস্তম ও হামজা লঞ্চটিকে আর উপরে তুলতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।

২০০৯ সালে ৪টি নৌ-দুর্ঘটনা

প্রতিবছরই সারাদেশে একাধিক ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে ২০০৯ সালে ঘটেছে বড় ধরনের ৪টি নৌ দুর্ঘটনা।

এরমধ্যে প্রথমটি ঘটেছে গত ১৯ জানুয়ারি চাদপুরের কাছে মেঘনা নদীতে। সেদিন তেলবাহী জাহাজের ধাক্কায় অর্ধশত শ্রমিকসহ ডুবে যায় এম ভি সাব্বির নামের একটি ট্রলার। ওই ট্রলার থেকে ২২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনার ঠিক একমাস পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে বালু বোঝাই কার্গো এমভি সানিম’র ধাক্কায় ডুবে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল হ্যাপি এক্সপ্রেস । মর্মান্তিক এ ঘটনায় মারা গেছেন  অর্ধশতাধিক যাত্রী  ।

গত ২৭ নভেম্বর পবিত্র ঈদুল আযহার আগের রাতে ঢাকা থেকে ভোলার লালমোহনগামী লঞ্চ এমভি কোকো-৪ দুই সহস্রাধিক যাত্রী নিয়ে  তেঁতুলিয়া নদীর নাজিরপুর ঘাটে ডুবে যায়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৮৭ জনের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ।

এ ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পর ৪ ডিসেম্বর শুক্রবার কিশোরগঞ্জের দাইরা নদীতে ট্রলার ডুবিতে মারা গেছে ৫৫ জন যাত্রী । ওইদিন সকালে মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোর ইউনিয়নের চারিগ্রাম ও ফুলপুর গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হাওরের ‘আইলা দাইরা হৈসর’ নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ এবং ট্রলারের মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রলারটি (ইঞ্জিনচালিত নৌকা) ডুবে যায়। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার শিকার অনেক যাত্রী সাঁতরিয়ে তীরে উঠে আসতে সমর্থ হলেও পুরুষ, মহিলা, শিশুসহ কমপক্ষে ২০-২৫ জন যাত্রী এখনো নিখোঁজ রয়েছে।

নৌ-দুর্ঘটনার কারন

ফিটনেস বিহীন নৌযান,অতিরিক্ত যাত্রী বহন, অদক্ষ চালক, প্রশিক্ষিত সারেংয়ের অভাব, ঝুঁকিপূর্ন নৌ-পথ, প্রয়োজনীয় বয়া-বিকন বাতি না থাকা, অতীতের দুর্ঘটনাগুলোর তদন্ত রিপোর্ট হিমাগারে পড়ে থাকা সহ কোন দুর্ঘটনায় দোষীদের শাস্তি না হওয়া সর্বোপরি বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার কারনে প্রায়ই নৌ-দুর্ঘটনা ঘটছে।

সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারে পৌঁছেছে। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হলেও দৃষ্টান্ত মূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মুনাফালোভী মালিক ও সরকারের সংশ্লি¬ষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীলরা বরাবরই রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

 

তদন্ত কমিটির তদন্ত করবে কে?

প্রতিবছর নৌ-দুর্ঘটনার পরপরই গঠিত হয় নানা ধরনের একাধিক তদন্ত কমিটি। প্রথম কয়েকদিন তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা বেশ তৎপর ও ফাইল চালাচালি করলেও একপর্যায়ে তা থেমে যায়। যারকারনে  এসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। অনেক সময় তদন্ত রিপোর্ট আদৌ প্রকাশ-ই করা হয়না । দু’একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়লেও সে অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়না সংশ্লিষ্ট বিভাগ। নানাভাবে ম্যানেজ হয়ে যায় তদন্ত কারী কিংবা ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। যারকারনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- তদন্ত কমিটি গুলোরই এখন তদন্ত হওয়া দরকার।

 

দু’যুগের পরিসংখ্যান

দেশের ৬ হাজার কিলোমিটার সচল নৌ পথে চলছে ২০ হাজার নৌযান। গত ২৫ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এসময়ে অন্তত ৩ শতাধিক নৌ-দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। নিখোজ হয়েছেন প্রায় ৩ হাজার। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েটি নৌ-দুর্ঘনার সংক্ষিপ্ত বিবরন-

১৯৮৬ সালের ২৪ মে  ডুবে যায় ঢাকা-ভোলা রুটের যাত্রীবাহী লঞ্চ এম ভি সামিয়া। এ লঞ্চডুবির ঘটনায় মারা যান আট শতাধিক মানুষ।

নব্বই দশকে একাধিক মর্মান্তিক নৌ-দুর্ঘটনার মধ্যে ১৯৯৯ সালের মে মাসে বরিশাল- লক্ষীপুর রুটের মেঘনায় ডুবে যায় এমভি ফাল্গুনি। এতে মারা যায় অর্ধশতাধিক মানুষ।

২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর ভোলার তেতুলিয়া নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় মারা যায় শতাধিক মানুষ। একই বছরের ৩০ নভেম্বর এম এল জাহাঙ্গীর ডুবে মারা যায় ৭০ জন

২০০২ সালের ৪ মে ঢাকা-পটুয়াখালী রুটের এমভি সালাউদ্দিন-২ ডুবিতে মারা যায় ৩২০ জন যাত্রী।

২০০৩ সালে ঢাকার ফতুল্লার কাছে বুড়িগঙায় লঞ্চডুবিতে মারা যায় দেড়শতাধিক যাত্রী।

একই বছরের ৮ জুলাই চাদপুরের ত্রিমোহনীতে ঢাকা- লালমোহন রুটের এমভি নাসরিন ট্রাজেডিতে মারা যায় ৮ শতাধিক যাত্রী।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়- প্রতিবছর গড়ে প্রায় এক হাজার মানুষ নৌ-দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে।

আর কত নৌ-দুর্ঘটনা ?

নিরাপদ যাত্রা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। অথচ নৌপথে তাদের প্রতিটি মুহুর্ত কাটে শংকার মধ্যে। কেউ ঘর থেকে বের হলে ফিরে না আসা পর্যন্ত পরিবারের লোকদের দুশ্চিন্তার অন্ত থাকেনা। অনিশ্চিত নৌ পথে প্রতিবছরই ঘটছে একাধিক দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। অথচ কোন সরকার-ই যাত্রীদের নিরাপদ নৌ যাতায়াতের কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেননা। এমনকি ডুবে যাওয়া লঞ্চ কিংবা মারা যাওয়া যাত্রীদের লাশ উদ্ধার এবং হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও চলে গড়িমসি। আহতদের চিকিৎসা কিংবা নিহতদের ক্ষতিপূরনের প্রক্রিয়ায়াও বেশ দীর্ঘ। এসব প্রক্রিয়া মেনটেইন করে শেষ পর্যন্ত অনেকে ক্ষতিপূরন পান না। ভোলার লালমোহন ও বরিশালের কীর্তনখোলায় লঞ্চডুবিতে নিহত যাত্রীদের পরিবারগুলোর স্বজনদের যে কান্না আর দুর্ভোগের চিত্র নিজ চোখে দেখেছি তা লিখে বোঝানোর সাধ্য কার? লাশের জন্য তেতুলিয়া আর কীর্তনখোলা নদীর তীরে কয়েকদিন যাবত স্বজনদের যে দুর্বিসহ করুন প্রতিক্ষা আর আহাজারি প্রত্যক্ষ করা গেছে তা শুধু অমানবিকই নয় বরং অগনতান্ত্রিকও বটে। কিন্তু এভাবে আর কতকাল?